সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৫৪ পূর্বাহ্ন
মৌলভীবাজার প্রতিনিধি; মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভেতর দিয়ে চলে গেছে ঢাকা-সিলেট রেল পথ এবং শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সংযোগ সড়ক পথ। লাউয়ছড়া বনের বুক ছিড়ে এই দুটি সড়কে ভাগ হয়ে আছে উদ্যানটি। সড়ক ও রেলপথের বিভিন্ন স্থান অনেক প্রশস্ত। এতে অনেক প্রাণী এক পাশের গাছ থেকে আরেক পাশের গাছে লাফ দিয়ে যেতে পারে না। কিছু প্রাণী নিচে নেমে সড়ক ও রেলপথ পাড়ি দেয়। এভাবে সড়ক ও রেলপথ পাড়ি দিতে গিয়ে অনেক প্রাণী মারা পড়ে। গত বছরের নভেম্বর থেকে গত আগস্ট মাস পর্যন্ত শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সড়কের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান এলাকায় চিত্রা হরিণ, বানর, মেছো বিড়াল, মুখপোড়া হনুমান ও চিতা বিড়ালসহ পাঁচটি বন্য প্রাণী মারা গেছে। করোনার কারণে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় এই সময়ে রেললাইনে বন্য প্রাণী কাটা পড়ার ঘটনা নেই। সড়কপথেও যান চলাচল কম ছিল। তবে বছরে এই দুটি পথে অর্ধশতাধিক বন্য প্রাণী মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া উদ্যানের ভেতর দিয়ে যাওয়া ৩৩ হাজার কেভি বৈদ্যুতিক সংযোগ থেকেও প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। প্রতি মাসে এই উদ্যানের সড়কে গাড়িচাপায় মারা যায় গড়ে ছয়টি বন্য প্রাণী।
বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের লাউয়াছড়া বন রেঞ্জ সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ২৮ অক্টোবর রাতে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভেতর দিয়ে যাওয়া কমলগঞ্জ-শ্রীমঙ্গল সড়ক পার হওয়ার সময় গাড়িচাপায় বিপন্ন প্রজাতির একটি শজারু মারা যায়। এ ঘটনার ১২ দিনের মধ্যে রাত আটটায় একই সড়কে গাড়িচাপায় মারা গেছে একটি গন্ধগোকুল। এর দেড় মাসের ব্যবধানে গাড়ির ধাক্কায় একটি বানরের মৃত্যু হয়েছে। ২৪ জানুয়ারি রাত নয়টার দিকে উদ্যানের ডলুবাড়ি এলাকায় ৩৩ হাজার কেভি বিদ্যুৎ লাইন স্পৃষ্ট হয়ে আহত হয়েছে একটি বানর। বানরটি এখনো চিকিৎসাধীন। সব শেষ গতকাল সোমবার ১৩ সেপ্টেম্বর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে একটি বানরের মৃত্যু হয়।
মৌলভীবাজারের বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক মো. আনিসুর রহমান বলেন, সাধারণত রাতে বন্য প্রাণী চলাচল করে থাকে। রাতে চলাচল করা গাড়ির চাপায় বন্য প্রাণী মারা যাচ্ছে। প্রতি মাসে গড়ে ছয়টি প্রাণী মারা যায়। এভাবে গত দুই বছরে দেড় শতাধিক বন্য প্রাণী মারা গেছে। এর মধ্যে বিভিন্ন জাতের ব্যাঙ, সাপ, শজারু, বানর, হরিণ, গন্ধগোকুল ও বন্য শূকর রয়েছে। সড়ক ও রেলপথের ওপরে বন্য প্রানীদের নিরাপদ যাতায়াতের সুবিধার্থে গত ২১ সেপ্টেম্বর থেকে ৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হাবিবুন নাহারের নেতৃত্বে একটি গবেষক দল স্থানীয় তিনজনকে নিয়ে যৌথভাবে নির্মাণ করেছে পাঁচটি বন সেতু (ক্যানোপি ব্রিজ)। এর চারটি রেলপথে এবং একটি সড়কপথের ওপর। উদ্যানকে দ্বিখন্ডিত করে চলে যাওয়া সড়ক ও রেলপথের দুই পাশের গাছের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছে এই সেতু। সড়কের দুই পাশের উঁচু দুটি গাছের সঙ্গে রশি বেঁধে বানানো হয়েছে সেতুগুলো। এই সেতু দিয়ে মহাবিপন্ন প্রাণী উল্লুকসহ অন্য সব বন্য প্রাণী সড়ক ও রেলপথের দুই পাশের বিস্তৃত উদ্যানে চলাচল করবে।সেতুগুলোর দূরত্ব ২২ থেকে ২৫ মিটার। নাইলনের মোটা রশি সড়ক ও রেলপথের দুই পাশের গাছের ডালপালার মধ্যে বেঁধে সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে। উলুকের চলাচল পর্যবেক্ষণের জন্য সেতুগুলোর কাছে ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। যার মাধ্যমে দিনে কয়টি উলুক কতবার এপার-ওপার আসা-যাওয়া করে, তা জানা যাবে। বন্য প্রাণীর চলাচলের সুবিধার্থে ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বন সেতু বা ক্যানোপি ব্রিজ আছে। তবে লাবুয়াছড়ায় এমন সেতু ধরে চলাচলে অভ্যস্ত হতে বন্য প্রাণীর কয়েক মাস সময় লাগে বলে গবেষক দলের সদস্যরা জানিয়েছেন।
গবেষক দলের প্রধান হাবিবুন নাহার এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘২০১৯ সালে উল্লুক চলাচল পর্যবেক্ষণ করেছি। অনেকবার দেখেছি পার হতে চায়। পার হতে পারে না। এরা নিচে নামে না। কখনো অনেক জায়গা ঘুরে আসা-যাওয়া করে।’ তিনি জানান, ‘প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএন, বাংলাদেশের লাল তালিকা অনুযায়ী বাংলাদেশে মহাবিপন্ন প্রাণী উল্লুকের উপযোগী পরিবেশ রয়েছে। এদের সংখ্যা বাড়ছে। এক জায়গায় থাকলে প্রতিযোগিতা হবে। তাদের মুক্তভাবে ছড়িয়ে দিতে এই উদ্যোগ। যাতে সব জায়গায় যেতে পারে। প্রতিযোগিতায় না যায়। বন বিভাগের অর্থায়নে প্রাথমিকভাবে লাউয়াছড়ার পাঁচ জায়গায় কৃত্রিম গাছ সেতু স্থাপন করা হয়েছে। পর্যবেক্ষণ করা হবে। যদি দেখি তারা ব্যবহার করে, তাহলে দেশের অন্য জায়গায়ও এ রকম সেতু করা হবে।’